নাকের পলিপাস নিরাময়

নাকের পলিপ কী এবং এগুলিকে কীভাবে শনাক্ত করা যায়?
নাকের পলিপগুলি নাসাপথে বা সাইনাসে ধরা পড়তে পারে। এগুলি নাকে তৈরি হওয়া যন্ত্রণাবিহীন, নরম এবং ক্যান্সারের চিহ্নমুক্ত অংশ। এগুলি নাকে অশ্রুকণা বা আঙুরের মত দেখতে লাগে এবং এর কারণে তীব্র প্রদাহ হতে পারে। এগুলি প্রায়শই অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বারবার সংক্রমণ, অনাক্রম্যতাজনিত রোগ অথবা কোনো ওষুধের প্রতি সংবেদনশীলতার কারণে হয়ে থাকে।
নাকের পলিপগুলি কী?
নাকের পলিপগুলি এবং সাইনাস অঞ্চলে অবস্থান এবং অস্বস্তির সৃষ্টি করে। ক্রনিক সাইনাসাইটিসের ক্ষেত্রে এটি 12 সপ্তাহের বেশি থাকতে পারে। যদিও এমন কিছু কিছু ঘটনা আছে, যেখানে নাকের পলিপগুলি কোন সাইনোসাইটিসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
অনেক রকম অনাক্রমতা জনিত অসুখ, অ্যাজমা অথবা অ্যালার্জি নাকের প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে এবং যদি এগুলিকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হয়, তবে এর কারণে নাকের পলিপ হতে পারে। যদি এগুলি আকারে কিছুটা ছোট হয়, তবে আপনার কোনো অসুবিধে নাও হতে পারে এবং আপনি এটি লক্ষ্যও না করতে পারে। কিন্তু যদি এটি বড় হয়ে যায়, তবে এটি আপনার নাকের প্রকোষ্ঠটিকে অবরুদ্ধ করে দিতে পারে। এই কারণে অধিক পরিমাণে শ্লেষ্মা তৈরি হতে পারে এবং এর কারণে সংক্রমণ ঘটতে পারে।
নাকের পলিপের জন্য কোন নির্দিষ্ট বয়স হয় না কিন্তু এটি অল্প বয়সী এবং মধ্য বয়সের লোকদের মধ্যে খুবই সাধারণ ব্যাপার। চোখ, গালের হাড় এবং নাকের মত জায়গায় নেসাল পলিপ হতে পারে।
নাকের পলিপের উপসর্গ
নাক দিয়ে জল পড়া অথবা নাক বন্ধ থাকা পলিপের একটি খুবই সাধারণ উপসর্গ। ধুলো, রাসায়নিক পদার্থ এবং ধোঁয়ার কারণে নাসাপথে আরো বেশি অস্বস্তি তৈরি হয় এবং এর কারণে আরো বেশী সংক্রমণ দেখা যায়। যদি 12 সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নাকের প্রকোষ্ঠে একটানা অস্বস্তি চলতে থাকে অথবা একটানা সাইনোসাইটিস থাকে, তবে নাকে পলিপ হতে পারে। যদি পলিপগুলি আকারে ছোট এবং নরম হয়, তবে এগুলি খুব বেশি সমস্যা তৈরি করতে পারে না। যদি পলিপগুলির সংখ্যা অনেক বেশী হয় অথবা আকারে খুব বড় হয়, তবে এগুলি নাকের প্রকোষ্ঠগুলিকে অবরুদ্ধ করে দিতে পারে।
নাকের পলিপের অন্যান্য উপসর্গগুলি হল:
মাথাব্যথা – মুখে অল্প থেকে প্রচণ্ড ব্যথা
একটানা নাক বন্ধ
প্রায়ই নাক অবরুদ্ধ থাকা
নাক দিয়ে জল পড়া
স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতু চলে যাওয়া
রাতে নাক ডাকা
সাইনাসের মাথাব্যথা
পোস্টন্যাসাল ড্রিপ
কপাল ও মুখে চাপের অনুভূতি
নাক থেকে রক্ত পড়া – রাতে বেশী করে
উপরের চোয়ালে ব্যথা – অল্প থেকে বেশী
নাকের পলিপের রোগনির্ণয়
নাকের পলিপ নিম্নলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব:
এন্ডোস্কোপি– এই পরীক্ষায় ডাক্তার একটি সরু নলে হাল্কা ম্যাগনিফাইং লেন্স অথবা মাইক্রো ক্যামেরার মাধ্যমে নাক এবং সাইনাসকে পরীক্ষা করবেন।
অ্যালার্জি টেস্ট – ত্বকের পরীক্ষা যাতে একটানা প্রদাহ হবার মত বিষয়গুলিকে চিহ্নিত করা যায়।
ভিটামিন ডি এর মাত্রার পরীক্ষা– রক্তের নমুনার পরীক্ষা করা হয় যাতে দেহে ভিতামিন ডি- এর মাত্রা নির্ধারণ করা যায়।
সিস্টিক ফাইব্রোসিস পরীক্ষা– যে গ্রন্থিগুলি শ্লেষ্মা, ঘাম, অশ্রু এবং পাচক রস উৎপন্ন করে, সেগুলিকে সিস্টিক ফাইব্রোসিস ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সিটি স্ক্যানের মত ইমেজিং স্টাডি- এর মাধ্যমে ডাক্তার আপনার সাইনাসের অনেক গভীরে পলিপের যথার্থ অবস্থান ও আকার বুঝতে পারেন। এটি ফেলা অথবা অস্বস্তির তীব্রতাকে বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করে। ইমেজিং স্টাডির মাধ্যমে ডাক্তার নাকের অন্য কোন প্রকোষ্ঠে ব্লকেজ আছে কিনা তা শনাক্ত করতে পারেন, যেমন গঠনগত অস্বাভাবিকতা আছে নাকি এবং কোন ক্যান্সার যুক্ত অথবা ক্যান্সার যুক্ত নেই এরকম কোন অংশ বেড়ে উঠেছে কিনা।
নাকের পলিপের সাথে যুক্ত ঝুঁকির কারণগুলি কী কী?
যে যে রোগগুলির কারণে সাইনাসের ফুলে যাওয়া অথবা অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে পারে, তার কারণে নাকের পলিপের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
নাকের পলিপের সঙ্গে যুক্ত রোগগুলি হল নিম্নরূপ:
অ্যাসপিরিনের প্রতি সংবেদনশীলতা
অ্যাজমা
সিস্টিক ফাইব্রোসিস (মানবদেহে অস্বাভাবিক আঠালো এবং পুরু তরল পদার্থ সম্পর্কিত একটি বংশগত ব্যাধি, যার মধ্যে আছে, নাক এবং সাইনাসের আস্তরণ থেকে ঘন শ্লেষ্মা)।
ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি
অ্যালার্জিক ফাংগাল সাইনাসাইটিস, বায়ুবাহিত ছত্রাকের জন্য অ্যালার্জি
উচ্চ ঝুঁকির বিষয়:
নাকের পলিপের জটিলতাগুলি হল
একটানা সাইনাসের সংক্রমণ
প্রবল অ্যাজমা
অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া
নাকের পলিপের চিকিৎসা কী?
যদি কম থাকে, তবে নাকের পলিপকে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। যদি এটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, তবে সার্জারি করার সুপারিশ করা হয়।
ওষুধ: ওষুধের মাধ্যমে নাকের পলিপকে চিকিৎসা করা সম্ভব। নাসাপথের চিকিৎসা করার জন্য বেশ কিছু নাকের স্প্রে এবং ওষুধ রয়েছে। কিন্তু যদি মৌখিক চিকিৎসার পরে অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যায় তবে সার্জারি একমাত্র উপায়। আদর্শ পদ্ধতিটি হল এন্ডোস্কোপিক সাইনাস সার্জারি, যা বহির্বিভাগের রোগীদের সার্জারি হিসেবে করা হয়।
নাকের কর্টিকোস্টেরয়েড: ছোট পলিপের জন্য কিছু স্টেরয়েড ওষুধ, যেমন ফ্লুটিক্যাসোন, বুডেসোনিড, বেক্লোমিথাসোন খুবই কার্যকরী। নাকের স্প্রেগুলি ফোলা ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে। অবশেষে, পলিপগুলি শুকিয়ে যায়।
মৌখিক বা ইঞ্জেক্ট করা যায় এমন কর্টিকোস্টেরয়েড: যদি নাকের স্প্রে ব্যবহার করেও প্রদাহ না কমে এবং আরো বেশি তীব্র হয়ে দাঁড়ায়, তবে মৌখিক বা ইনজেক্ট করা যায় এমন কর্টিকোস্টেরয়েডকে সুপারিশ করা হয়।
অন্যান্য ওষুধ: যদি একটি নাকের পলিপ এবং সাইনোসাইটিসের একটি সমন্বয় হয় তবে ডাক্তার ডুপিলুমাব যুক্ত ইঞ্জেকশন ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, তীব্র অথবা বারবার সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। আর অ্যালার্জির ক্ষেত্রে অ্যান্টিহিস্টামিন যথেষ্ট উপকারী।
সার্জারি: যদি নাকের পলিপ আরো তীব্র হয়ে যায়, তবে পরবর্তী বিকল্প হল সার্জারি। এন্ডোস্কোপি সার্জারির মাধ্যমে নাকের প্রকোষ্ঠের ভিতরের পলিপ অপসারণ করা হয়। এটি একটি সহজ পদ্ধতি এবং আপনি সেই দিনে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন। সার্জারি হওয়ার পর আবার পলিপ হওয়া আটকানোর জন্য নাকের স্প্রে ব্যবহার করা হয়।
যদি আপনার নাকের পলিপ থেকে থাকে তবে কী কী প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
যদি আপনি নাকের পল্পকে তীব্রতর রূপ ধারণ করার আগেই একে কমানোর জন্য প্রতিরোধমূলক কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তবে বেশী ভালো হয়।:
অ্যালার্জি ও অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণ করুন- যদি আপনি আপনার উপসর্গগুলিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারেন, তবে আপনার অবশ্যই নিজের ডাক্তারকে অনুরোধ করা উচিৎ যে তিনি যেন বর্তমান চিকিৎসার পরিবর্তে অন্য কোনো চিকিৎসার সুপারিশ করেন।
ভাল স্বাস্থ্য বজায় রাখা- আপনার নিজের হাতকে ভালোভাবে ধোয়া উচিত কারণ এটি আপনার হাত থেকে ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাসকে দূর করতে সবচেয়ে ভালো কাজ করে। যখন আপনি আপনার নাককে স্পর্শ করেন, তখন এটি নাসাপথ অথবা সাইনাস এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসকে সঞ্চারিত হতে বাধা দেয়।
নাককে যা কিছু উত্যক্ত করে তা এড়িয়ে যান- তামাক ধূমপান, ধুলো, রাসায়নিক ধোঁয়া এবং সূক্ষ্ম ধ্বংসাবশেষগুলি আপনাক অথবা সাইনাসের ফোলা বা অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
একটি নাক মোছার স্প্রে ব্যবহার করুন- আপনার নাসাপথকে পরিষ্কার করার জন্য আপনার একটি নুন জলের স্প্রে অথবা ন্যাসাল ওয়াশ ঘনঘন ব্যবহার করা উচিত। এটি আপনার শ্লেষ্মার প্রবাহকে আরও ভালো করবে এবং সমস্ত অ্যালার্জেন এবং অস্বস্তি সৃষ্টিকারী পদার্থগুলিকে ধুয়ে দেবে।
আপনার বাড়িকে উষ্ণ এবং আর্দ্র রাখুন- একটি হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করে আপনি আপনার ঘরকে উষ্ণ রাখতে পারেন, যার ফলে আপনার শ্বাসনালীগুলি আর্দ্র থাকবে। এটি আপনার সাইনাসের শ্লেষ্মা প্রবাহকে আরও ভালো করতে সাহায্য করে এবং প্রদাহ ও ব্লকেজকে অপসারণ করে। হিউমিডিফায়ারে ব্যাকটেরিয়া এবং জীবাণুর উৎপত্তি যাতে না হয়, তার জন্য কখনোই হিউমিডিফায়ারকে পরিষ্কার করতে ভুলবেন না।
পাইলস বা অর্শ রোগ
পাইলস একটি অতি পরিচিত স্বাস্থ্য সমস্যা। এটি অর্শ রোগ নামেও পরিচিত। অনেকেই এই সমস্যায় দীর্ঘদিন ভুগলেও এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে বা ডাক্তার দেখাতে সংকোচ বোধ করেন। ক্ষেত্রবিশেষে পাইলস এর সঠিক চিকিৎসার বদলে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি ঔষধ ও অন্যান্য টোটকা গ্রহণ করেন। এসব কারণে পাইলস ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে। তাই পাইলস বা অর্শ রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এ সম্বন্ধে সচেতন হওয়া জরুরি।
পাইলস বা অর্শ রোগ কী?
পায়ুপথ বা পায়খানার রাস্তার মুখ যদি কোনো কারণে ফুলে যায় এবং সেখান থেকে রক্ত পড়ে কিংবা পায়খানার রাস্তায় যদি গোটার মত হয় তখন একে বলা হয় পাইলস। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম হেমোরয়েড। জটিল আকার ধারণ করার আগে অপারেশন ছাড়া অর্শ রোগের চিকিৎসা সম্ভব।
পাইলস এর লক্ষণগুলো কী?
পাইলস বা অর্শ রোগের অন্যতম চারটি লক্ষণ নিচে তুলে ধরা হলো। এসব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।
১. পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া
পাইলস হলে পায়খানার সাথে উজ্জ্বল লাল বর্ণের অর্থাৎ তাজা রক্ত যেতে পারে। সাধারণত পায়খানার পরে টয়লেট পেপার ব্যবহার করলে সেখানে রক্তের ফোটা লেগে থাকতে পারে। অথবা কমোডে বা প্যানের গায়ে টকটকে লাল রক্তের ছোপ দেখা যেতে পারে।। পাইলস হলে পায়ুপথের মুখে থাকা অ্যানাল কুশনগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এই রক্ত বেরিয়ে গিয়ে জমাট বাধার সুযোগ পায় না। এ কারণে এক্ষেত্রে তাজা লাল রঙের রক্ত দেখা যায়।
কিন্তু যদি কোনো কারণে পায়খানার সাথে গাঢ় খয়েরী রঙের রক্ত যায়, বা আলকাতরার মতো কালো ও নরম পায়খানা হয়, তবে তা সাধারণত পাইলস এর কারণে নয়। পরিপাকতন্ত্রের কোনো অংশে রক্তপাতের কারণে পায়খানার সাথে এমন গাঢ় রক্ত যেতে পারে, তাই এমনটা হলে রক্তপাতের কারণ জানার জন্য দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
২. পায়ুপথের মুখের অংশগুলো বেরিয়ে আসা
পাইল হলে সাধারণত মলত্যাগের পরে অ্যানাল কুশনগুলো নরম গোটার মতো বের হয়ে আসে। এগুলো কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এগুলো আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকানোর প্রয়োজন হতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে আঙ্গুল দিয়েও গোটাগুলো ভেতরে ঢোকানো যায় না।
৩. পায়খানার রাস্তায় ব্যথা হওয়া
পাইলস রোগে সাধারণত তীব্র ব্যথা হয় না। তবে যদি পায়ুপথের গোটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সেগুলো আঙুল দিয়ে ঠেলেও ভেতরে ঢোকানো না যায়, এবং সেগুলোতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে অনেক সময় তীক্ষ্ণ বা তীব্র ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হয়। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে ঘরোয়া উপায়ে ব্যথার চিকিৎসা করা যায়।
৪. পায়খানার রাস্তায় চুলকানি
পাইলস হলে কখনো কখনো পায়ুপথে বা এর মুখের আশেপাশে চুলকানি হতে পারে। এছাড়া পায়ুপথ দিয়ে মিউকাস বা শ্লেষ্মা-জাতীয় পিচ্ছিল ও আঠালো পদার্থ বের হতে পারে। অনেক সময় মলত্যাগ করে ফেলার পরও বারবার মনে হতে পারে যে পেট পরিষ্কার হয় নি, আবার মলত্যাগ করা প্রয়োজন।
পাইলস ও এনাল ফিসার-এর মধ্যে কিভাবে পার্থক্য করবেন?
পাইলস ও এনাল ফিসার বা গেজ রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও এই দুইটি পৃথক দুইটি রোগ। দুটি রোগেই পায়ুপথে চুলকানি হতে পারে এবং টাটকা লাল রক্ত যেতে পারে। তবে এনাল ফিসারে রক্ত খুব অল্প পরিমাণে যায়। পাইলস এবং এনাল ফিসার এই দুইটির মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে—
পাইলস হলে পায়ুপথে নরম গোটার মত দেখা দেয়। গোটাগুলো সাধারণত মলত্যাগের পরে বের হয়ে আসে, আবার কিছু সময় পর নিজে নিজেই ভেতরে ঢুকে যায় অথবা আঙ্গুল দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে হয়। এছাড়া পাইলস হলে পায়ুপথে শ্লেষ্মার মতো দেখতে পিচ্ছিল কিছু পদার্থ বের হতে পারে।
এনাল ফিসার বা গেজ রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত এসব লক্ষণ দেখা যায় না। আর এক্ষেত্রে প্রতিবার মলত্যাগের সময়ই তীব্র ব্যথা হয়। পাইলসে সাধারণত ব্যথা হয় না।
এনাল ফিসার বা গেজ রোগের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে আমাদের আর্টিকেলটি পড়তে পারেন।
পাইলস কেন হয়?
কিছু কিছু জিনিস পাইলস এর ঝুঁকি বাড়ায়, সেই সাথে ইতোমধ্যে কারো পাইলস রোগ হয়ে থাকলে তার তীব্রতাও বাড়িয়ে দেয়, যেমন—
- শক্ত বা কষা পায়খানা
- মলত্যাগের সময় জোরে চাপ দেয়া
- অনেক সময় ধরে মলত্যাগের কসরত করা
- পায়খানার বেগ আটকে রাখা
- শারীরিক পরিশ্রম না করা
- অতিরিক্ত ওজন
এছাড়া গর্ভাবস্থায় নানান শারীরিক পরিবর্তনের কারণেও কারও কারও ক্ষেত্রে পাইলস এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স্বাভাবিক অবস্থায় পায়খানার রাস্তা বা পায়ুপথের মুখ সাধারণত বন্ধ থাকে। যখন প্রয়োজন হয়, তখন চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ খুলে শরীর থেকে পায়খানা বা মল বের করে দেওয়া হয়।
পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সেখানে বেশ কিছু জিনিস একসাথে কাজ করে। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল অ্যানাল কুশন। এই কুশনগুলো ৩ দিক থেকে চাপ দিয়ে পায়ুপথের মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করে।
যদি কোনো কারণে তিন দিকের এই কুশনগুলো ফুলে যায়, সেগুলো থেকে রক্তক্ষরণ হয়, সেগুলো নিচের দিকে নেমে যায়, অথবা পায়ুপথের চারপাশে গোটার মত দেখা যায়, তখন তাকে পাইলস বা অর্শ রোগ বলা হয়ে থাকে।
পাইলস এর ব্যথা সারানোর উপায়
পাইলস এর ব্যথা উপশম করতে প্যারাসিটামল ঔষধ খাওয়া যেতে পারে। এই ব্যথায় কার্যকরী অন্যান্য ঔষধ ও মলম পাওয়া যায়, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। ঘরোয়া পদ্ধতিতে অর্শ রোগের ব্যথা কমানোর ৪টি উপায় নিচে তুলে ধরা হলো—
১. ব্যথার জায়গাটি কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখা যায়। ছোট বাচ্চাদের গোসল করানো হয় এমন আকারের একটি বোলে কুসুম গরম পানি নিয়ে সেখানে বসতে পারেন। দিনে ৩ বার পর্যন্ত এটি করা যায়। অন্য সময়ে কোথাও বসতে গেলে একটি বালিশ ব্যবহার করে সেটার ওপর বসা যেতে পারে।
২. একটা প্যাকেটে কিছু বরফ নিয়ে সেটা তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে পায়ুপথে গোটাগুলোর ওপরে লাগানো যায়। এতে আরাম পাওয়া যাবে।
৩. বিছানায় শুয়ে পা উঁচু করে রাখলে পাইলস এর গোটাগুলোতে রক্ত চলাচল সহজ হবে ও ব্যথা উপশম হবে। শোবার সময় পায়ের নিচে বালিশ দিতে পারেন। এছাড়া খাটের পায়ার নিচে কোন কিছু দিয়ে খাটের এক পাশ উঁচু করে সেদিকে পা দেওয়া যেতে পারে।
৪. পায়ুপথ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শুকনো রাখতে হবে। মলত্যাগের পর জোরে ঘষাঘষি না করে আলতোভাবে জায়গাটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। টয়লেট পেপার হালকা ভিজিয়ে তারপর সেটা দিয়ে মুছতে পারেন।
যেসব ব্যথানাশক ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না
ট্রামাডল: এই ঔষধের একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য, তাই অর্শ রোগের জন্য এটি খাওয়া যাবেনা। প্যারাসিটামল ও ট্রামাডল একত্রে আছে এমন ব্যথানাশকও এড়িয়ে চলতে হবে।
আইবুপ্রোফেন: এটি রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আপনার পায়ুপথে ব্যথার সাথে রক্ত গেলে এটি খাওয়া যাবেনা।
কখন দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?
পাইলস হলে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। যেমন—
- টানা ৭ দিন বাসায় চিকিৎসা নেয়ার পরেও অবস্থার উন্নতি না হলে
- বারবার পাইলস এর সমস্যা হলে
- ৫৫ বছরের বেশি বয়সী কারও প্রথমবারের মত পাইলস এর লক্ষণ দেখা দিলে
- পাইলস থেকে পুঁজ বের হলে
- জ্বর বা কাঁপুনি হলে, অথবা খুব অসুস্থ বোধ হলে
- অনবরত রক্তক্ষরণ হলে
- অত্যধিক রক্তপাত হলে (উদাহরণস্বরূপ, যদি কমোডের পানি লাল হয়ে যায় বা পায়ুপথ দিয়ে রক্তের বড় বড় চাকা যায়)
- তীব্র, অসহনীয় ব্যথা হলে
- পায়খানার রঙ কালচে বা আলকাতরার মত কালো মনে হলে
পাইলস এর ঘরোয়া চিকিৎসা
পাইলস এর চিকিৎসা জন্য পাইলস হওয়ার কারণগুলো প্রতিরোধ করতে হবে। অর্শ রোগ সারানোর ৬টি কার্যকর ঘরোয়া উপায় নিচে তুলে ধরা হলো—
১. কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচতে বেশি বেশি আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার খতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে শাকসবজি, ফলমূল, ডাল, লাল চাল ও লাল আটার তৈরি খাবার। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। ফাইবার পানি শোষণ করার মাধ্যমে পায়খানা নরম করে, তাই ফাইবারকে কাজ করতে হলে সারাদিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে।
এই দুটো কাজ করলে সাধারণত কয়েকদিনের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাইলস এর সব ধরনের লক্ষণ উপশম হয়। ৬ সপ্তাহ অর্থাৎ দেড় মাস ধরে যদি খাবারে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইবার নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ৯৫ শতাংশ পাইলস রোগীর পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া কমে আসে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ইসবগুলের ভুসি একটি কার্যকর ঔষধ।
প্রতিদিনের খাবারে ফাইবারের পরিমাণ বাড়ানো নিয়ে বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।
২. মলত্যাগের সময় খুব জোরে চাপ দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পায়খানা যাতে নরম হয় এবং সহজেই মলত্যাগ করা যায়, সেই উপদেশগুলো মেনে চলতে হবে।
৩. মলত্যাগে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা যাবে না। টয়লেটে বসে ম্যাগাজিন, পেপার, মোবাইল-এসবে মনোনিবেশ করা বাদ দিতে হবে।
৪. পায়খানার চাপ আসলে তা আটকে রাখা উচিত না, এতে পায়খানা আরও শক্ত হয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। চাপ আসলে দেরি না করে বাথরুমে চলে যেতে হবে।
৫. নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করতে হবে। ব্যায়ামের মধ্যে ভারী ব্যায়াম বা প্রতিদিন দৌড়ানো বেছে নিতে হবে, তা নয়। শরীরকে চলমান রাখতে হাঁটাচলা, হালকা স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম ইত্যাদির মধ্যে যেকোনোটাই বেছে নেওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে হাঁটাহাঁটি বা হালকা শরীরচর্চাও কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
প্রয়োজনে অল্প অল্প করে শুরু করতে পারেন। দিনে ২০ মিনিট হাঁটুন। এক বেলা দিয়ে শুরু করুন, এরপর সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা করে হাঁটুন। প্রথমে সপ্তাহে তিন দিন এভাবে হেঁটে আস্তে আস্তে সেটা পাঁচ দিনে নিয়ে আসুন।
৬. ওজন অতিরিক্ত হলে তা কমিয়ে ফেলতে হবে। ওজন বেশী হলে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, তাই পাইলস এর রোগীদের ওজন কমানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ওজন কমানোর কার্যকর উপায় নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমাদের এ সংক্রান্ত আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন।
পাইলস এর অপারেশন
ঘরোয়া চিকিৎসার উপদেশ এবং ডাক্তারের ঔষধ সেবনের পরামর্শগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার পরেও যদি অর্শ রোগের এর সমাধান না হয়, সেক্ষেত্রে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। এ ব্যাপারে আপনার চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দিবেন। সাধারণত ৩ ধরনের অপারেশন করা হয়ে থাকে—
১. হেমোরয়েডেকটোমি: এই অপারেশনের মাধ্যমে পাইলস এর গোটাগুলো কেটে অপসারণ করা হয়।
২. স্টেপলড হেমোরয়েডোপেক্সি: এই পদ্ধতিতে সার্জারির মাধ্যমে পাইলস এর গোটাগুলো পুনরায় পায়ুপথের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
৩. হেমোরয়েডাল আর্টারি লাইগেশন: এক্ষেত্রে পাইলস এর গোটাগুলোর রক্ত সরবরাহ অপারেশনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়া হয়, যাতে গোটাগুলো শুকিয়ে যায়।
এসব অপারেশনের জন্য সাধারণত এনেসথেসিয়া বা চেতনানাশক ব্যবহার করে রোগীকে অজ্ঞান করা হয় এবং সার্জারির পর দুই-একদিন হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হতে পারে।